ইহুদিদের সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি।
ইহুদিরা বিশ্বের বুকে চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্র ও অপকর্মকারী জাতি হিসেবে ইতিহাস সর্বজনবিদিত। পবিত্র কোরআনুল করিমে তাদেরকে অভিশপ্ত ও লাঞ্ছিত জাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুদখোর ও লোভী জাতি হিসেবেও তাদের পরিচয় রয়েছে। এ জাতি যুগ যুগ ধরে তাদের খারাপ কর্মকাণ্ডের জন্য অন্যান্য জাতির মানুষদের কাছে অত্যন্ত ঘৃণাভরে পরিচিতি পেয়ে এসেছে। জন্মগতভাবেই এই জাতি খুবই চতুর, ধুরন্ধর ও অত্যন্ত মেধাবী হিসেবে পরিচিত। এরকম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা অন্যের ওপর দিয়ে যুগে যুগে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।
ইহুদি নামকরণ ও ইহুদি জাতির ইতিহাস:-

উৎপত্তিগত ভাবে ‘ইহুদি’ শব্দটা হিব্রু। সেমেটিক (মধ্যপ্রাচীয়ও) ধর্মগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ধর্ম হল এই ইহুদি ধর্ম।
ঐতিহাসিকদের মতে, ইয়াকুবের/জ্যাকবের পুত্র ইয়াহুদা‘র নাম থেকে হিব্রু “ইয়াহুদী”, অতঃপর আরবী ইয়াহুদী হয়ে বাংলায় “ইহুদি” শব্দের আগমন।
ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী, ইব্রাহীমের পুত্র ইসহাক, তার পুত্র ইয়াকুব ওরফে ইস্মাইল এর বংশধরগণ বনী-ইসরায়েল নামে পরিচিত। বনি ইসরাইল হচ্ছে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত ইব্রাহিম এর বংশধরদের একটি শাখা। ইয়াকুবের বারো পুত্রের নামে বনী-ইসরায়েলের বারোটি গোষ্ঠির জন্ম হয়, যার মধ্যে ইয়াহুদা‘র ছেলেমেয়েরা যারা যুডিয়া প্রদেশের কেনানে বসবাস করতো, এ শাখারই একটি অংশ পরবর্তীকালে নিজেদের ইহুদি নামে পরিচয় দিতে থাকে।
ধর্মগত দিক থেকে মুসলিমদের সাথে ইহুদিদের মিল সবচেয়ে বেশী। তাদেরকে আহলে কিতাব হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাই একজন মুসলিম ইহুদিদের হাতে জবেহকৃত পশু খেতে পারে, তাদের নারীদের ধর্মান্তরিত না করেও বিয়ে করতে পারে, তারা মুসলিমদের মতনই খৎনা করে, শুকরের মাংস খায়না। তাদের সম্পর্কে একটু জানাশোনা থাকলে টুপি-দাড়িওয়ালা ধার্মিক মুসলিম ও ইহুদি রাব্বির যত মিল পাবেন, খ্রীষ্টান পাদ্রী বা মিনিস্টার প্যাস্টরের সাথে তার ভগ্নাংশও পাবেন না। ইহুদিদের সিনাগগে(মসজিদে) ঈশ্বর বা ঈশ্বরের পুত্রের কোন মুর্তি পাবেন না। মুসলিম আর ইহুদিরা একই নিরাকার প্রভুকে মানে। এরপরও আমাদের আর তাদের সাথে বিরোধ কেন এত বেশী?
তার আগে আরেকটি কথা বলা জরুরী। খ্রিষ্টানদের সাথে ইহুদিদের বিরোধ কিন্ত আরও অনেক গুণ বেশি। ইহুদিরা ঈসাকে কখনই নবী বা মসিহা বলে মানেনি। তারা ঈসা নবীর ভার্জিন বার্থ বা ঈশ্বরত্ব মানতে পারেনি। আর ইহুদিদের বলা হত “ক্রাইস্ট কিলার” বা “জিশুর হন্তারক”।
বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী ইসরাইল ভূখন্ডের তৎকালীন রোমান গভর্নর পিলেত যীশুখ্রীষ্টকে মৃত্যুদন্ড দিতে আগ্রহী ছিল না। মূলত ইহুদিদের চাপে সে যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করতে বাধ্য হয়। আর এই ইহুদিরা নিজেদের বংশধরদের উপরও খ্রীষ্ট হত্যার দায়ভার গ্রহণ করে, এটা নিয়ে গর্ব বোধও করে।
ইহুদি জাতি জন্মকাল থেকেই পোড় খাওয়া ও কষ্ট সয়ে সয়ে আজকের এই অবস্থায় এসেছে। বহু বছর আগে ব্যাবিলনের রাজা আক্রমন করেছিল। ব্যাবিলনীয় সৈন্যরা ইহুদিদের ঘরে ঘরে প্রবেশ করে তাদের হত্যা করে, বাকি সমস্ত লোকজনকে বন্দী করে পুরো ইসরাইলী জাতিটাকে ক্রীতদাসে পরিণত করে তাদের দেশ ব্যাবিলেনে নিয়ে গেল,ইহুদিদের ডেভিড মন্দির ধ্বংস করে দিলো তারা।
যিহোবা বা স্রস্টা আবার সিরিয়ায় ফিরিয়ে এনে তাদের ওপর দয়া করলেন। ইহুদিরা আবার ধনে-জনে সমৃদ্ধ হয়ে উঠলো, তারা তাদের ডেভিড মন্দির পুনঃনির্মাণ করলো। ৭০-খ্রীস্টাব্দে রোমান টিটাস ইহুদিদের আক্রমণ করে তাদের আবার গণহারে হত্যা শুরু করলো, তাদের মেয়েদের নিয়ে গেলো, ধন-সম্পত্তি সব লুটে নিলো, ইহুদিদের ডেভিড মন্দির সহ তাদের রাজধানী যেরুজালেম শহর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিলো এবং তারপর সিরিয়া থেকে সমস্ত জাতিটাকে সমূলে উচ্ছেদ করে দিলো।
পূর্ববর্তী প্রাচীন পৃথিবীতে ইহুদীরা ছিলো বিশ্বের প্রাচীনতম জাতি ও ধর্মধারী। ‘যিহোবা’কে তারা বিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা মনে করতো। যিহোবার অন্য নাম ছিল ‘‘ইয়াহওয়া, যোহেভান, ইলোহিম, শেখিনা, মাকোম’’ ইত্যাদি। এটি আব্রাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও মোজেস কর্তৃক প্রবর্তিত বিশ্বের প্রথম কিংবা প্রধানতম একেশ্বরবাদী ধর্ম ছিল। ইহুদীরা পৃথিবীর সর্বত্র বসবাস করতো প্রাচীনকাল থেকেই। যখন যেখানের যে ধর্ম তাই তারা অনুসরণ করতো। ব্যাবিলনে থাকাকালীন ব্যাবিলনের ধর্ম, আবার মিশরে বসবাসের সময় মিশরীয় ফারাওদের ধর্ম মানতো ইহুদীরা। প্রায় ৫০০০ বছর আগে সুমেরু দেশের উর শহরে আব্রাম নামে এক লোক বাস করতো, যাকে ইহুদীরা তাদের ‘জাতির পিতা’ ও নবী মনে করতো। তিনি আদেশ পেলেন যে, স্রষ্টা তথা ‘যিহোবা’কে মেনে চললে ‘যিহোবা’ তাদের এমন এক দেশ উপহার দিবেন, যেখানে শান্তি-ই শান্তি! আব্রাম বা পরবর্তীতে আব্রাহাম তার জাতি তথা ইহুদীদের কল্যাণের জন্যে যেহোবার সাথে এভাবে এক ‘চুক্তির’ মাধ্যমে যে ‘শান্তির দেশে’ তার জাতিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার নাম ছিল ‘কেনান’ (প্যালেস্টাইন)। ইহুদীদের প্রথম মন্দিরে নুহের জাহাজ, কল্পিত ‘চিরুবিম’ পশুর মূর্তি ছিল। ‘চিরুবিম’ ছিল আকাশে ভাসমান উড়ন্ত এ্যাঞ্জেল, যাতে উপবেশন করতো ‘যিহোবা’ নিজে। ইহুদীরা তাদের প্রার্থনালয়ে ‘যিহোবা’র কোন মূর্তি রাখতো না কেবল তার পুজো করতো। আবার তারা ‘যিহোবা’ কে ভুলে গিয়ে বেল, মার্ডুক ইত্যাদি দেবতার পুজোও শুরু করে দিয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। পূজা থেকে বাদ পড়ার কারণে ‘যিহোবা’ তাই রেগে তাদের শাস্তি দেন কখনো কখনো। পর্যায়ক্রমে তাদের উপর বিশেষ প্রতিনিধি বা নবী ধারাবাহিকভাবে প্রেরণ শুরু করে ইহুদীদেরকে ‘যিহোবা’র পথে আনা ও ধরে রাখার জন্যে। এরূপ অনেক প্রেরিত প্রতিনিধির মধ্যে বিশেষ একজন ছিলেন নবী ‘মোজেস’ যাকে মুসলমানরা ‘মুসা’ বলতো। ‘যিহোবা’ ইহুদীদের মিশর থেকে ‘নিজস্ব দেশ কেনানে’ নিয়ে যাওয়ার জন্যে ‘মোজেস’কে একটি পাহাড়ে বিদ্যুতের অক্ষরে লিখে ১০-টি নির্দেশনা দেন। যেগুলো ইহুদীরা ১০-নির্দেশনা হিসেবে খুবই মান্য করতো।
যাই হোক, এভাবে বিতাড়িত হতে হতে একসময় হাজার হাজার বছরের বাসস্থান থেকে উৎখাত হয়ে ইহুদিরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করলো।
ইসলামের নবীর আগমনকালে ইহুদিদের প্রধান কয়েকটি বসতি ছিল মদিনা ও তার আশেপাশে। ইসলামের নবীর আগমনের পর থেকে প্রথমে মদিনা ও পরবর্তীতে সিরিয়া ও সমগ্র আরব ভূমি থেকে ইহুদি তথা ইসরাইলিদের তাদের ষড়যন্ত্র মূলক কর্মকাণ্ডের জন্য হত্যা ও বাস্তুচ্যুত করা হয়, যার প্রমাণ ইসলামের ইতিহাস ও কোরান-হাদিস সর্বত্র সহজ প্রাপ্য।
সাম্প্রতিক সময়ে ইহুদি-বিদ্বেষ খুবই বহুল প্রচলিত একটা টার্ম। ইহুদি-বিদ্বেষ বলতে ইহুদি জাতি, গোষ্ঠী বা ধর্মের প্রতি বৈরিতা বা বিদ্বেষ বোঝানো হয়ে থাকে। এধরনের বিদ্বেষের মধ্যে ব্যক্তিগত ঘৃণা থেকে শুরু করে সংঘবদ্ধ হত্যাকাণ্ডও পড়ে। ইংরেজিতে একে বলা হয় এন্টি-সেমিটিজম, যার অর্থ দাঁড়ায় সেমিটিয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ। খ্রিস্টান-শাসিত ইউরোপে সংখ্যালঘু ধর্মীয়-গোষ্ঠী হিসেবে ইহুদিরা বিভিন্নসময় ধর্মীয় বিদ্বেষ, নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হত। ধর্মীয় নির্যাতনের মধ্যে ছিল ধর্ম-পালনে বাধা, জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ, দেশ থেকে বিতাড়ন ইত্যাদি। শিল্প-বিপ্লবের পর ইহুদিদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতিঘটতে থাকে দ্রুত। এসময় ইউরোপে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটলে ইহুদিদের প্রতি জাতিগত বিদ্বেষ দেখা দেয়।
এই জাতিগত বিদ্বেষ ভয়াবহ চরম আকার ধারণ করে বিংশ শতকের তৃতীয় দশকে,হিটলারের নাৎসি দল-শাসিত জার্মানিতে। ইহুদি-বিরোধী এই জাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের দায়ও ইহুদিদের উপর চাপিয়ে দিয়ে তারা বিভিন্ন অত্যাচার এবং নিধনমূলক আইন-কানুন প্রণয়ন করে। ১৯৩৯ সালে হিটলার বিভিন্ন দেশ আক্রমণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটালে ইউরোপে ইহুদি নির্যাতন ও নিধন চরমরূপ নেয়। তারা আইন করে ইহুদিদের নিজস্ব নিবাস অধিগ্রহণ করে বন্দী-নিবাসে প্রেরণ করে এবং পর্যায়ক্রমে ইহুদিদের হত্যা করে। প্রায় ৬০ লক্ষ/৬মিলিয়ন ইহুদিকে হত্যা করা হয়, যা ইতিহাসে ‘হলোকাস্ট‘ নামে পরিচিত।
এতো অত্যাচার সয়েও ইহুদিরা তাদের নাশকতামূলক কর্মকান্ড ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা বন্ধ করেনি বরং বর্তমানে তারা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্যের তুঙ্গে অবস্থান করছে।
মুসলিমরা বিশ্বাস করে, মহান আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ী করবেন। যেমনভাবে মুসলিম পূর্বপুরুষরা প্রথমবার মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করে পৃথিবীতে তাদের গর্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিলেন ঠিক তেমনি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আগে অথবা তাঁর সাথে মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করবে এবং তাদের আধিপত্য, গর্ব ও শ্রেষ্ঠত্বকামিতার ধ্বংস সাধন করবে।