ওসামা বিন লাদেনের নাম শোনেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। কেননা তিনি এমন একজন মানুষ যার কথা এখনো আপনাকে নিউজ পেপার কিংবা অন্য কোন সংবাদমাধ্যম অথবা যেকোন আন্তর্জাতিক আলোচনার মধ্যে টেনে আনতে হবে। তার পুরো নাম ওসামা বিন মোহাম্মদ বিন আওয়াদ বিন লাদেন। বিশ্বব্যাপী তিনি ওসামা বিন লাদেন নামে পরিচিত তার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন আল কায়েদা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের অন্যতম বড় বিজ্ঞাপন। ইতিহাসখ্যাত টুইন টাওয়ার হামলার সাথে জড়িত থাকার জন্য এই সংগঠনটি যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী তালিকায় সবসময় এক নাম্বারে ছিল। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয় সংগঠনটি বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের নতুন দ্বার উন্মোচন করেছিল।
আল-কায়েদার জন্ম হয় ১৯৭৯ সালে, যে সময় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে ওসামা বিন লাদেন তখন আফগানিস্তান জুড়ে ভ্রমণ করে আরব যোদ্ধাদের সংঘটিত করে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আফগানিস্তানকে সাহায্য করেন। ওই যুদ্ধে আফগানিস্তান বিজয়ী হয়। এরপর থেকে ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
ওসামা বিন লাদেন আরো কয়েকজন ইসলামী জঙ্গিদের সাথে মিলে মুসলিম জনতার জন্য দুইটি ফতোয়া জারি করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে একটি, ১৯৯৯ সালে আরেকটি। তার মধ্যে ছিল যেকোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উচিত মার্কিন সামরিক ও বেসামরিক জনগণকে হত্যা করা যতক্ষণ না পর্যন্ত মার্কিনিরা ইজরায়েলকে সহায়তা করা বন্ধ করে এবং সকল মুসলিম দেশ সমূহ থেকে তাদের সামরিক শক্তি অপসারণ করে।
১৯৯৬ সালে মার্কিন সেনাদের সৌদি আরব ত্যাগ করতে নির্দেশ প্রদান করেন, ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর আমেরিকার ওপর আল-কায়েদা একইসাথে ৪৩টি সমন্বিত সন্ত্রাসী হামলা চালায় যা নাইন ইলেভেন নামেও পরিচিত। এই আক্রমণে প্রায় তিন হাজার মানুষ নিহত, হয় ছয় হাজারের অধিক মানুষ আহত হয়। ১০ বিলিয়ন ডলার এর অধিক অবকাঠামো ও সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বুঝতেই পারছেন ওসামা বিন লাদেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কতটা ঘৃণিত হয়ে উঠেছিল।
ওসামা বিন লাদেন জন্মগ্রহণ
ওসামা বিন মোহাম্মদ বিন আওয়াদ বিন লাদেন জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৭ সালের দশই মার্চ সৌদি আরবের রিয়াদে। তার পিতা ছিলেন অত্যন্ত ধনী ব্যক্তি, ওসামা বিন লাদেন ছিলেন তার পিতার বায়ান্ন সন্তানের মধ্যে ১৭তম। বাদশা আবদুল্লাহ আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অর্থনীতি ও ব্যবসা প্রশাসন নিয়ে লেখাপড়া করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তার সবচেয়ে আগ্রহের বস্তু ছিল ধর্ম। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায় তিনি তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। তার পিতার অঢেল সম্পত্তির থেকে প্রায় ত্রিশ মিলিয়ন ডলার লাভ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে বিন লাদেন একজন নম্র ভদ্র ও মিশুক মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি একজন অসাধারণ পিতা হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। তার সন্তানদের সাথে প্রায়ই মরুভূমিতে আনন্দ অনুষ্ঠান করতেন।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচয় লাভের আগে ওসামা বিন লাদেন আমেরিকার একজন ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আফগানিস্থানে রুশ আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য ওসামা বিন লাদেনকে আমেরিকার প্রয়োজন ছিল, এজন্য তারা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে ও সমর্থন দিয়ে ওসামা বিন লাদেনকে তৈরি করেছিলেন। কিন্তু এই সমর্থন পরবর্তীতে তাদের দিকে ধেয়ে আসবে এমনটা হতো তারা চিন্তা করেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর থেকেই মিত্র লাদেন পরিণত হন শত্রুতে। লাদেন তার শত্রু আমেরিকার মোকাবেলার জন্য বেছে নেন সন্ত্রাসের পথ। তিনি ইসলামের অবক্ষয় এর জন্য দায়ী করেন আমেরিকাকে। তার প্রতিষ্ঠিত আল কায়দায় তিনি জায়গা দিতেন সব মেধাবী জিহাদিদের। ওসামা বিন লাদেন টেকনোলজি প্রিয় মানুষ ছিলেন, তিনি বিশ্বাস করতেন আধুনিক যুগে টিকে থাকতে হলে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেই যুদ্ধ করতে হবে। ওসামা বিন লাদেনের জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন টুইন টাওয়ার হামলা, যেটা নাইন ইলেভেন নামে পরিচিত। এটা ছিল চারটি পরিকল্পনা সমন্বিত হামলা। হামলার পরপর আল-কায়েদা এর দায় স্বীকার করেনি তারা বলেছিল যারা এই কাজ করেছে খুব ভালো করেছে কিন্তু এটি আল-কায়দা করেনি। পরবর্তীতে টুইন টাওয়ার হামলার দায় স্বীকার করেন তারা। নাইন ইলেভেনের পর যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৫০টিরও বেশি সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধ করতে পেরেছিল কিন্তু আল-কায়েদা সব সময় একটি ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছিল তাদের জন্য।
বিশ্ব কাঁপানো ওসামা বিন লাদেন ২০১১ সালের মে মাসের ২ তারিখে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে এক কমান্ডো হামলায় মৃত্যুবরণ করেন। একটি গোপন সূত্রে খবর পেয়ে আমেরিকান কমান্ডোরা দুইটি অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার ব্যবহার করে লাদেনের বাসভবনে হামলা চালায়। উক্ত হামলায় লাদেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, তার লাশ ডিএনএ প্রযুক্তির মাধ্যমে সমাপ্ত করার পর আরব সাগরে দাফন করা হয়।
ওসামা বিন লাদেনের সর্বশেষ সাক্ষাৎকার
ওসামা বিন লাদেনের সর্বশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীর। বিন লাদেনের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎকারে লাদেনের বিভিন্ন কৃতকর্মের প্রতিবাদে তিনি সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করেন। লাদেনকে তার কাজের ব্যাপারে নানা ধরণের প্রশ্ন করেছেন। মোট তিনবার লাদেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন হামিদ মীর। এই সাক্ষাৎকার নেওয়ার কারণে হামিদ মীর অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। অনেকে তার সাথে আল কায়েদার সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছিল কিন্তু হামিদ মীর সব সময় বিশ্বাস করতেন তিনি একজন সাংবাদিক হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করছেন। ওসামা বিন লাদেন হামিদ মীরকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতেন কারণ তিনি লাদেনের বক্তব্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করতেন। লাদেন তার মাধ্যমে বেশ কয়েকবার বিবৃতি প্রচার করেছিল। শেষ সাক্ষাৎকারে হামিদ মীর যখন লাদেনের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন নিরাপত্তারক্ষীরা সন্দেহ করেছিল যে বাইরে একজন গুপ্তচর রয়েছে যেকোনো মুহূর্তে হামলা হতে পারে। মুহূর্তেই ওই স্বাভাবিক পরিস্থিতি উত্তেজনার সৃষ্টি হয় সবাই চারদিকে চিৎকার করা শুরু করে কিন্তু তখনও ওসামা বিন লাদেন অত্যন্ত শান্ত ছিলেন। তিনি হামিদকে চলে যেতে বলেন আর ওটাই ছিল ওসামার সাথে তার শেষ কথোপকথন। ৫ মিনিটের মধ্যেই সবাই সেখান থেকে সরে গিয়েছিল আর ১০ থেকে ১২ মিনিটের মধ্যেই সেখানে বোমা হামলা শুরু হয়েছিল! সেই হামলা থেকে হামিদ মীর একটুর জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন. হামিদ মীরই ছিলেন সর্বশেষ সাংবাদিক ওসামা বিন লাদেন এর সাক্ষাৎকার নিতে পেরেছিলেন।