প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা

19 Oct

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবন্ধিতা হল কোন ব্যক্তির শারীরিক সীমাবদ্ধতা বা অক্ষমতা যা তাকে সার্বিক কাজে অংশগ্রহণ করা থেকে বাধার সম্মুখীন করে। সাধারণত গর্ভকালীন জটিলতা জন্ম ও জন্মপরবর্তী সময় কোনো গুরুতর দুর্ঘটনা কিংবা আকস্মিক মানসিক সমস্যা ইত্যাদির কারণে একজন মানুষ প্রতিবন্ধিত্ব বরণ করে নেয়। এরকম পরিস্থিতিতে সাধারণ জীবন যাপনে অক্ষম ব্যক্তিকেই প্রতিবন্ধী বলা যায়।

বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন 2001 অনুযায়ী প্রতিবন্ধী বলতে এমন কাউকে বোঝানো হয় যিনি জন্মগতভাবে বা দুর্ঘটনা শিকার রোগাক্রান্ত হয়ে অপচিকিৎসা অথবা অন্য কোনো কারণে শারীরিক ভাবে বিকলাঙ্গ অথবা মানসিক ভারসাম্যহীন এবং ওই ভারসাম্যহীনতা অথবা বিকলাঙ্গতার ফলে স্থায়ীভাবে সম্পূর্ণ অথবা আংশিক কর্মক্ষমতাহীন ও স্বাভাবিক জীবন-যাপনে অক্ষম।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশের বর্তমান জনগোষ্ঠীর প্রায় দশমিক সাত ভাগ লোক প্রতিবন্ধিত্বের শিকার। সে হিসেবে বর্তমানে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় সতের লাখ। অতিরিক্ত জনসংখ্যা, দারিদ্রতা, নিরক্ষরতা, সুচিকিৎসার অভাব ইত্যাদি কারণে দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

প্রতিবন্ধিতা বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে যেমন শারীরিকভাবে যারা চলনে অক্ষম তাদেরকে শারীরিক প্রতিবন্ধী বলা হয়, যারা দেখতে পান না তাদেরকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বলা হয়, এরকম শ্রবণ প্রতিবন্ধী, বাকপ্রতিবন্ধী, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিভিন্ন প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। প্রতিবন্ধিতার কারণ প্রকৃতভাবে আমাদের জানা সম্ভব হয়নি, কিন্তু ধারণা করা হয় সাধারণ কারণ হিসেবে দুর্ঘটনা, বংশানুক্রমিক মারাত্মক রোগ, বিষক্রিয়া, অপুষ্টি, আয়োডিনের অভাব, বেশি বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভবতী মায়ের শারীরিক সমস্যা, তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদি প্রতিবন্ধিতার জন্য দায়ী হতে পারে।

শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের অবস্থান

শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের অবস্থান

বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধীদের অনেক বাঁধা বিঘ্নতা সম্মুখীন হতে হয়। মৌলিক অধিকার শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধীরা অনেক পিছিয়ে আছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ খুবই সামান্য। আর এই সীমাবদ্ধতার জন্য অসামঞ্জস্য পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা, বৈরিতাপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ, অনমনীয় শিক্ষাক্রম, সামাজিক অজ্ঞতা ও সচেতনতা হীনতা, শিক্ষকদের আন্তরিকতার অভাব ইত্যাদি কারণ দায়ী। সরকারি হিসাব অনুযায়ী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাত্র 5% প্রতিবন্ধী শিশুরা শিক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের কে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় একত্ব করতে হলে শিক্ষকদের এই ধরনের শিশুদের বিকাশ ও শিখন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবশ্যই প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। তবে সরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার কারণে ধীরে ধীরে এই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। সরকার স্বল্পমাত্রায় প্রতিবন্ধীদের জন্য একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে এই ধরনের প্রকল্প স্বল্পমাত্রার প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য মূলধারায় আনার একটি বাস্তব পদক্ষেপ। একই সময়ে সরকার প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকারের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও সংস্থা গুলো প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষা বিস্তারে সরকারিভাবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা চট্টগ্রাম রাজশাহী খুলনা একাধিক বিশেষায়িত বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। এই সকল বিদ্যালয় সর্বমোট ৬০০ শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দেওয়া এবং ১৮০ শিশুকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আবাসন সুবিধা দিতে সক্ষম। চাঁদপুরের বাবুরহাট এলাকায় সরকারি বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ইশারা ভাষা শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষা প্রদান করা হয়। সরকারিভাবে তাদের ভরণপোষণ আবাসন চিকিৎসা ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭৪ সালে এই বিদ্যালয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য একটি সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়।

শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য দেশজুড়ে সাতটি বিশেষায়িত বিদ্যালয় রয়েছে এই বিদ্যালয়সমূহে ৭০০ শিশু শিক্ষা নয় এবং ১৮০ শিশুকে বিনামূল্যে আবাসিক সুবিধা প্রদান করা হয়।

প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে করণীয়

প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে করণীয়

বাংলাদেশের মানুষের প্রচলিত ধারণা ছিল প্রতিবন্ধিতা এক ধরনের অভিশাপ, প্রতিবন্ধী মানুষরা আমাদের সমাজের উপর একটা বোঝা. কিন্তু এইসব ধারণা বর্তমান সরকারের সময়ে আমূল পরিবর্তন এসেছে আর যে মানুষটি এটার পিছনে নিরলস পরিশ্রম করেছেন তিনি হলেন আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।

তিনি বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে অটিজম সচেতনতা নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। বর্তমানে দেশে অটিজম বিষয়ক জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন তিনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের অন্যতম সদস্য তিনি। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বর্তমান সরকার ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন এর মাধ্যমে। চিকিৎসাসেবা ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার অর্জনে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিভিন্ন ধরণের সেবা প্রতিবন্ধীদেরকে বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। সরকারি কাজে তাদের উপযুক্ত অংশগ্রহণের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট কোটা ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়েছে। বিশেষ সুবিধা হিসেবে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধীদের জন্য ৫% কোটা রাখা হয়েছে।

কিন্তু এতকিছু করার পরও দেশের প্রতিবন্ধীরা খুব বেশি ভালো আছে এটা বলা সম্ভব না। কারণ উন্নয়নের সুষম বন্টন ও মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে না দেওয়া গেলে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রতিবন্ধীদের সমান চোখে দেখে মূলধারায় সম্পৃক্ত করে দেশের সকল ক্ষেত্রে সকলে সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে বিশেষ করে শিক্ষা চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তায় প্রতিবন্ধীদের গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব আর প্রতিবন্ধীরা সেই মানব সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষ হিসেবে সমাজে বেঁচে থাকার সকল মৌলিক অধিকার তাদেরও সমানভাবে প্রাপ্য। প্রতিবন্ধীদের প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শন ও ভালো ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধান যথাযথ অনুসরণ করা উচিত। মানবতার ধর্ম ইসলাম প্রতিবন্ধীদের প্রতি যথাযথ ব্যবহার করার নির্দেশনা দেয় প্রতিবন্ধীদের সাথে সদাচরণ তাদের প্রতি সাহায্য সহযোগিতা করা এবং তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যাপারে ইসলাম নির্দেশনা দেয়। প্রতিবন্ধীদের উপহাস ব্যঙ্গ বিদ্রুপ অথবা ঠাট্টা তামাশা করা স্বয়ং আল্লাহ কে উপহাস করার শামিল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ(সঃ) বলেছেন, “তোমরা ক্ষুধার্তকে খাবার দাও অসুস্থ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের খোঁজখবর নাও এবং বন্দীকে মুক্ত করে দাও” -সহি বুখারী।

প্রতিবন্ধীরা আমাদেরই সন্তান ওরা আমাদের বোঝা নয়। সরকারের পাশাপাশি সামাজিক ভাবে ও পারিবারিক ভাবে আমাদের সবাইকে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে কাজ করতে হবে, কারন সমাজের একটা অংশ কে পিছিয়ে রেখে সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাদেরও মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সমাজের সকল স্তরের মানুষের সম্মিলিত উন্নয়নমূলক অংশগ্রহণ থাকতে হবে। তাহলেই একটি সুখী সমৃদ্ধ সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *