মুভির নাম:
‘The Color of Paradise’
সহজ বাংলায় ‘স্বর্গের রঙ’।
মুভির পরিচালক মাজিদ মাজিদি নামের এক অসাধারণ মানুষ। যিনি ইরানী মুভিকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছেন। মুভিতে যেভাবে অক্ষমতার বাস্তবতা একদম নিখুঁত করে ফুটিয়ে তুলেছেন তাতে স্তব্ধ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। পৃথিবীর যে কোন মানুষের মন কেঁদে উঠতে বাধ্য এই অসাধারণ মুভিটি দেখে। দুঃখ আর হতাশার চিত্র গুলো একেবারে উন্মুক্ত করে তুলে ধরেছেন পরিচালক মাজিদ মাজিদি। কোন রাখঢাক করেননি। মুভির চরিত্রগুলোর দুঃখ আর যন্ত্রণাগুলো যেন নিজে অনুভব করবেন। খুব কম মুভি এখন পর্যন্ত এভাবে ছুঁয়ে যাবে মনকে।
বর্তমান যুগের হাজারো অ্যাকশন, ফ্যান্টাসি, সাই-ফাই মুভির ভিড়ে এমন একটা মুভি যা হয়তো কয়েকবার দেখতে বাধ্য করবে আপনাকে , অনেকদিন মনের কোণে উঁকি দিয়ে থাকবে।

যাইহোক এখন সরাসরি মুভির রিভিউতে যাওয়া যাক :
গল্পটা মোহাম্মাদ নামের এক অন্ধ বালকের যে তেহরান শহরে এক অন্ধস্কুলে পড়াশোনা করে। গ্রীষ্মের ছুটিতে সবাই যখন তাদের বাবা মায়ের সাথে বাড়ীতে চলে তখনও মোহম্মদ এর নিম্নবিত্ত বাবা রামেজানি এসে হাজির হননি। মোহম্মদ এর মনে হতে থাকে তার বাবা আর তাকে নিতে আসবেন না, কিন্তু বেশ কিছু সময় পর বাবা আসেন আর স্কুল কতৃপক্ষকে অনুরোধ করেন যেনো তারা মোহম্মদ কে রেখে দেয় কিন্তু স্কুল কতৃপক্ষ এতে রাজি হয়না।
এরপর বাবা অনিচ্ছাসত্ত্বেও মোহম্মদ কে গ্রামের নিজেদের বাড়ীতে নিয়ে যান। গ্রামের বাড়ীতে থাকে তার দাদী আর কিউট দুই বোন। সে গ্রামের মানুষের কিছুটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। মোহম্মদ এর মা অনেক আগেই মারা গেছে কিন্তু বাবা এতোদিন আর বিয়ে করেননি।

কিন্তু এভাবে চললে তো মুভি হবে না! মুভিতে দরকার কিছু অপ্রত্যাশিত মোড়, যা এনে দেয় বাবার ২য় বিয়ের ইচ্ছা। মেয়ে তাদের গ্রামের পাশের গ্রামে থাকে। মেয়ের পরিবার জানে না ওই বাবার একটা অন্ধ ছেলে আছে।
রামেজানি আসলে নিজেই লুকায় ব্যাপারটা কারণ কারো পরিবারে প্রতিবন্ধী থাকা ওই পরিবারের জন্য অভিশাপ হিসেবে ধরা হয়।
রামেজানি চায় ওই মেয়েটাকে বিয়ে করতে কিন্তু মোহম্মদ থাকতে তা সম্ভব না তাই সে মোহম্মদ কে এক অন্ধ কাঠমিস্ত্রির কাছে রেখে আর দাদীকে কৈফিয়ত দেয় যে এটা মোহম্মদ এর ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই সে করেছে কিন্তু দাদী তা অগ্রাহ্য করে বাড়ী থেকে বেরিয়ে যায়।
এর বেশি কিছু বললেই স্পয়লার হয়ে যাবে।

এরপর আপনি নিজেই দেখে নিন,
দাদীর পরিণতি কি হয়,
বাবার বিয়েটা কি শেষ পর্যন্ত হয় কিনা,
মোহম্মদ আবার বাড়ী ফিরতে পারে কিনা,
শেষে মোহম্মদেরই বা কি পরিণতি হয়।
এখন কথা হলো এই সাদামাটা গল্পটা আপনাকে কেনো টেনে নিয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত?
সবার আগে আসবে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আর লোকেশন গুলো। হ্যাঁ আমি এটা অন্তত বলতে পারি এই মুভির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আমার মুভি দেখার ইতিহাসে বেস্ট।
এই মুভিটার নির্মাণ আর গল্পের সততা আপনাকে আবিষ্ট করে নেবে। অন্ধ মোহম্মদ কে নিয়ে তার বাবার হীনমন্বতা আর তার পরিবারের কষ্ট আপনিও অনুভব করতে পারবেন।
হলিউড কিংবা বলিউড বা অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রি গুলোতে যে মুভি বানানো হয় তা বেশিরভাগই হয় সমসাময়িক বাস্তবতা বর্জিত কিন্তু অপরদিকে ইরানী মুভি গুলো অত্যন্ত খোলামেলা ভাবে নিজেদের কঠিন বাস্তবতার কঠিন কষ্ট আর হতাশাময় জীবনের সকল হাসি আর বেদনার প্রতিচ্ছবি এঁকে দেয়।
মোহম্মদ এর চরিত্রে মোহসেন রামেজানির অভিনয় এক কথায় অপার্থিব। কিভাবে এতটুকু একটা বাচ্চা ছেলে এমন অভিনয় করতে পারে তা নিয়ে আপনি ভাবনায় পড়তে বাধ্য হবেন।
এর সাথে সাথে বাবাসহ বাকী সবার অভিনয়ও ছিল মাস্টারক্লাস।
মুভিটি দেখার সময় একবারও মনে হয়নি যে তারা সবাই অভিনয় করছে , এতটাই বাস্তবসম্মত ছিল। আর মুহাম্মদের মুখের দিকে তাকালেই কেন যেন চোখ বেয়ে পানি নেমে আসতে চায়।
মুভির সব দৃশ্যায়ন ছিল অসাধারণ সুন্দর। বিশেষ করে মুহাম্মদের গ্রামটি ছিল ছবির মত সুন্দর…. পাহাড়-ঝরনা, ফুল, নদী,পাখি, প্রজাপতি…… অসাধারণ।
এবার আসি কিছু ভালো লাগার দৃশ্যে
মোহম্মদের পাখির বাসায় হাত দেওয়ার দৃশ্য…
বাসে বসে বাতাস ধরার দৃশ্য…
বোনের মুখে হাত বোলানোর দৃশ্য….
বাবার গাছে ঝোলার দৃশ্য….
মোহম্মদের ব্রেইলে পড়ার দৃশ্য….
কাঠমিস্ত্রির সাথে স্রস্টা বিষয়ক কথোপকথন এর দৃশ্য…..
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মুভিটির শেষ দৃশ্য।
কথায় আছে শেষ ভালো যার সব ভালো। আর এই কথাটির যথার্থ প্রয়োগ দেখতে পাবেন এই মুভিটিতে।
নির্দ্বিধায় বলতে পারি এই মুভির শেষ দৃশ্যটি আপনার দেখা অন্যতম সেরা শেষদৃশ্য হতে যাচ্ছে।
অনেক দিন যদি ভালো কোনো সুস্থধারার মুভি না দেখে থাকেন তাহলে এই মুভিটি দেখুন।
মুভিটি ১৯৯৯ সালের অস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিল কিন্তু ‘Life is Beautiful’ নামের এক অতি অসাধারণ আরেকটি মুভি সেবারের অস্কার ছিনিয়ে নেয়।
এবার শেষ করি মুভির কিছু টেকনিক্যাল ডিটেইলস দিয়ে,
The Color of Paradise
Release date: 9th February 1999
IMDB: 8.2
Rotten Tomatoes: 87%